রাজধানীর কাফরুলের বাসিন্দা মোসলেম উদ্দিন। মৌসুমি সবজির খুচরা কারবার করেন তিনি। এতে যা আয় হয় তা দিয়ে চলে তার চার সদস্যের পরিবার। কিন্তু পথে-ঘাটে বেপরোয়া চাঁদাবাজি তার ব্যবসা কঠিন করে তুলেছে। একই সঙ্গে চাঁদাবাজির কারণে বাড়ছে সবজির দাম। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে ক্রেতার ওপর। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও অস্বাভাবিক মাত্রায় ঊর্ধ্বমুখী। মোসলেম জানালেন, কাওরান বাজার পাইকারি মার্কেট থেকে সবজি কিনে আগারগাঁও সঙ্গীত কলেজের সামনের অস্থায়ী ‘ভোরের বাজারে’ তুলতে পথেই তিন স্পটে গুনতে হয় চাঁদার টাকা। এরপর বাজারে বিক্রি শেষে লাইনম্যানদের দিতে হয় চাঁদা। চাঁদাবাজদের এমন দৌরাত্ম্য রাজধানীর সর্বত্র।
পেশাদার চক্রের বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ অটোরিকশা, ভ্যানগাড়ি, ফুটপাতের হকার থেকে শুরু করে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। পুলিশ ও স্থানীয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাববলয়ে থাকা কতিপয় ব্যক্তিই এই চাঁদাবাজিতে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় পুলিশ ও পেশাদার চাঁদাবাজচক্রের সদস্যরা এখন অতিমাত্রায় সক্রিয়। এরা এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন খাত থেকে নিত্যদিন চাঁদা তুলছে। এসব খাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-অস্থায়ী কাঁচাবাজার, অস্থায়ী খাবার দোকান, বিভিন্ন ধরনের নিষিদ্ধ যানবাহন, রাস্তা ও ফুটপাত দখলে নিয়ে বসানো দোকানপাট। ঈদ সামনে রেখে এলাকাভিত্তিক প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে অনেক জায়গায় চাঁদাবাজ চক্রের সদস্যরা মুখোমুখি অবস্থান করছে। গোয়েন্দাদের কাছেও এমন তথ্য রয়েছে। আরও জানা গেছে, প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত চলে শান্তিনগর ভোরের বাজার।
শান্তিনগর মোড় থেকে মালিবাগ মোড় যেতে মূল সড়কের একাংশ ও ফুটপাত দখল করে বসে কাঁচাবাজার। এই বাজারে মাছ, মাংস, ডিম থেকে শুরু করে সব ধরনের শাকসবজি পাওয়া যায়। দুই ঘণ্টার এই বাজারে কয়েক লাখ টাকার বেচাকেনা হয়। এ বাজারে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসতে প্রতি দোকানদারকে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা চাঁদা দিতে হয়। এই বাজার থেকে প্রতিদিন মোটা টাকা চাঁদা তোলা হয়। চাঁদার টাকা কতিপয় পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় কয়েক ব্যক্তির মধ্যে ভাগাভাগি হয়। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী থানার সামনে ও পেছনে মহাসড়ক দখল করে কাঁচাবাজার বসে প্রতিদিন। আছে অবৈধ লেগুনা, ট্রাক ও পিকআপ স্ট্যান্ড। এখান থেকে দৈনিক কয়েক লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়।
এছাড়া যাত্রাবাড়ী মাছ, ফল ও কাঁচাবাজারে ট্রাক-পিকআপে মাছ নিয়ে এলেই বেপারিদের গুনতে হচ্ছে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা। বিভিন্ন নামে-বেনামে এসব চাঁদা আদায় করা হয়। যাত্রাবাড়ী মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে অবৈধ দোকান ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত শনির আখড়া, রায়েরবাগ, মাতুয়াইল, তুষারধারা, সাদ্দাম মার্কেট, মহাসড়কের ওপর ফুটপাত দখল করে অবৈধ সিএনজি, ইজিবাইক ও অটোরিকশা, প্রাইভেট কার স্ট্যান্ড এবং সড়কের দুইপাশে দোকান বসিয়ে চলছে বেপরায়া চাঁদাবাজি। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-কতিপয় পুলিশ সদস্যের যোগসাজশে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা নামধারীরা এখান থেকে চাঁদা তোলে।
সরেজমিন জানা যায়, যাত্রাবাড়ী থানার সামনে ও পেছনে হিউম্যান হলার ও লেগুনা পরিবহণ স্ট্যান্ড রয়েছে। মহাসড়কে লেগুনা পরিবহণ নিষিদ্ধ হলেও ২ শতাধিক লেগুনা মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়ায়। প্রতি লেগুনা পরিবহণ থেকে জিপির নামে দৈনিক ৫৫০ টাকা, লাইনম্যানের নামে ২০ টাকা করে আদায় করা হয়। যাত্রাবাড়ী ট্রাফিক পুলিশ বক্স থেকে সুফিয়া প্লাজা পর্যন্ত সড়ক ও ফুটপাতে ৩০টি দোকান বসিয়ে প্রতি দোকান থেকে দৈনিক ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা করে আদায় করেন জনৈক সোনামিয়া। ৫০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাসুম মোল্লার কথা বলে যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে শতাধিক তরকারি, মাছ কাটার বডি, বরফের দোকানসহ হরেকরকমের দোকান বসানো হয়েছে। এসব দোকান থেকে দৈনিক ২০০ থেকে ৩০০ টাকা করে আদায় করেন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নামধারী কয়েক নেতা। এছাড়া যাত্রাবাড়ী টিএন্ডটি অফিসের সামনে বাস কাউন্টার, সিএনজি স্ট্যান্ড ও দোকান থেকে দৈনিক ২-৩শ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়।
এছাড়া কুতুবখালী বউবাজারের সামনে ট্রাক থামলে ২০০ টাকা চাঁদা নেয় ৫০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাসুম মোল্লার ভাগ্নে জামাই। তাছাড়া কুতুবখালী বউবাজারের সামনে দিয়ে রিকশা বা ভ্যানগাড়িতে করে মালামাল নিয়ে যেতে ১০-২০ টাকা করে চাঁদা আদায় করেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নামধারী নেতা শাহাদাত হোসেনের লোকজন। আরও জানা গেছে, শনির আখড়া ফুটওভার ব্রিজের দক্ষিণ পাশে দনিয়া কলেজ থেকে শনির আখড়া ব্রিজের পশ্চিমপাশের ঢাল পর্যন্ত চা, কপি, ফাস্টফুডসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর শতাধিক দোকান রয়েছে। ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা করে নিয়ে প্রতিটি দোকান বসানো হয়েছে।
আর প্রতিটি দোকান থেকে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করেন যুবলীগের নামধারী কয়েক নেতা। রায়েরবাগ ফুটওভার ব্রিজের উত্তরপাশে ফল, ফুচকা, চা, বাদাম, ডাবসহ হরেকরকমের প্রায় ৮০টি দোকান রয়েছে। প্রতিটি দোকান বসাতে অগ্রিম নেওয়া হয়েছে ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা। দৈনিক ২-৩শ টাকা করে চাঁদা আদায় করেন যুব ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের স্থানীয় দুই নেতা। এই চাঁদার টাকায় ভাগ পান স্থানীয় ট্রাফিক ও থানা পুলিশের কয়েকজন সদস্য। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন যাত্রাবাড়ী ক্ষতিগ্রস্ত পাইকারি দোকান মালিক সমিতির সহসভাপতি মোমিন মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক শামীম কবির ভুঁইয়া প্রায় একই ধরনের তথ্য তুলে ধরে বলেন, যাত্রাবাড়ীর বেপরোয়া চাঁদাবাজি প্রতিরোধ করা দরকার।
রাত ১১টার সময় ১০-১২ জনের একটি দল হাতে লাটি নিয়ে বিভিন্ন যানবাহন থামিয়ে যার কাছে যেমন পারছে চাঁদা আদায় করছে। এভাবে ভোর পর্যন্ত চলতে থাকে। এছাড়া যাত্রাবাড়ী আড়তে ট্রাক, পিকআপ, ভ্যানগাড়িসহ যে কোনো গাড়ি এলেই চাঁদা দিতে হচ্ছে। এতে করে একদিকে মালামালের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে বেপারিরা যাত্রাবাড়ীর মাছের ও কাঁচাবাজার এবং ফলের আড়ত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সরেজমিন দেখা গেছে, ডেমরা-যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা-রামপুরা সড়কের দুপাশ দখল করে অবৈধভাবে বসানো হয়েছে শত শত স্থায়ী-অস্থায়ী দোকানপাট। ডেমরার হাজীনগর, সারুলিয়া বাজার, বড়ভাঙ্গা, ডগাইর বাজার, ফার্মের মোড়, কোনাপাড়া, মাতুয়াইল, বাদশা মিয়া রোড, বাঁশেরপুল, রানীমহল, গলাকাটা, আমুলিয়া, ঠুলঠুলিয়া, ধিৎপুরা, তাম্বুরাবাদ, মেন্দিপুর, পাইটি, শূন্যা টেংরা ও ডেমরা বাজার এলাকাসহ সর্বত্রই অবৈধ দোকানপাট বসানো হয়েছে। প্রায় প্রতিটি এলাকায় যানবাহন স্ট্যান্ড ও বাজার বসানো হয়েছে অবৈধভাবে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, সড়কের পাশে স্থাপন করা এসব দোকানপাট থেকে প্রতিনিয়ত পুলিশের কতিপয় সদস্য ২ থেকে ৪শ টাকা আদায় করে। প্রতিটি অস্থায়ী দোকান ও ভ্যানগাড়ি থেকে দৈনিক ৫০ থেকে ১৫০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এখানকার চা, পান, সিগারেটের দোকানদারও চাঁদাবাজি থেকে রেহাই পায় না। এসব অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করা হলেও দু-একদিনের মধ্যে টাকার বিনিময়ে আবারও বসে যায়। এসব দোকান থেকে চাঁদাবাজির বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’। এছাড়া এলাকায় ইজিবাইক নামানো বাবদ ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা চাঁদা গুনতে হয়। প্রতিটি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও অটোরিকশা বাবদ ৫০০ টাকা দিতে হয় প্রতিদিন। চাঁদাবাজির বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ডেমরা জোন) মো. শাহ ইফতেখার আহম্মেদ বলেন, অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে অবৈধ দখল ও অব্যবস্থাপনা এখন বাস্তবতা।
এক্ষেত্রে রাজনৈতিক মহলের সজাগ দৃষ্টি প্রয়োজন। তবে চাঁদাবাজির সঙ্গে পুলিশের জড়িত থাকার বিষয়টি অনেক সময় লাইনম্যানরা বলে বেড়ায়। তারপরও চাঁদাবাজির সঙ্গে কতিপয় অসাধু পুলিশ, রাজনীতিক ও প্রভাবশালী মহলের সমন্বয় থাকতে পারে। যদি কোনো পুলিশের সম্পৃক্ততা থাকে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরেজমিন দেখা গেছে, বাবুবাজার সেতুর নিচে সরকারি জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে আওয়ামী হকার্স লীগ কোতোয়ালি থানা শাখার কার্যালয়। ওই অফিসে বসে এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন সংগঠনটির সভাপতি পিন্সু হাজি ও সাধারণ সম্পাদক আনসার ভূঁইয়া। দুজনে মামাতো-ফুপাতো ভাই। এদের মদদে বাদামতলী ফলের আড়তে ফল নিতে আসা পরিবহণ থেকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এছাড়া বাবুবাজার সেতুর নিচে আওয়ামী হকার্স লীগের অফিসের পেছনের সরকারি জায়গার একটি অংশ দখল করে আরেকটি চাঁদাবাজচক্র সেখানে দোকান বসিয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পাইকারি ফলের বাজারকে টার্গেট করে গড়ে উঠেছে পেশাদার চাঁদাবাজচক্র। বাদামতলীর সীমানায় গাড়ির চাকা ঘুরতে হলে বাবুবাজার ব্রিজের নিচে তাদের সিন্ডিকেটকে চাঁদা দিতেই হয়। বাবুবাজার এলাকার একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চাঁদাবাজরা খুবই ভয়ংকর। ফয়েজ, মোস্তফা, জুয়েল, মাসুম, বাবুসহ বেশ কয়েকজন এই চক্রের সক্রিয় সদস্য। আর সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত আনসার ভূঁইয়ার নেতৃত্বে চাঁদা তোলে মজিবর, জামাল, আলেকসহ আরও কয়েকজন। জানতে চাইলে পিন্সু হাজি ও আনসার ভূঁইয়ার প্রায় একই ধরনের তথ্য দিয়ে বলেন, কিছুদিন ধরে তারা বাবুবাজার ব্রিজের নিচে অফিস নিয়ে বসেছেন।
মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজির কথা অস্বীকার করলেও এখানে চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করেছেন দুজনেই। কোতোয়ালি থানার ওসি মিজানুর রহমান বলেন, চাঁদাবাজির ব্যাপারে থানায় কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব। সরেজমিন দেখা যায়, ব্যস্ততম মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংকের গলি, দৈনিক বাংলার মোড়, দিলকুশা রোড, আইডিয়াল স্কুলের সামনে শত শত অবৈধ দোকানপাট। এসব দোকানপাট থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলা হচ্ছে। এসব দোকানপাটের কারণে তীব্র যানজটে আটকে যায় রাজধানী।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।